।। দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং
।।
।
।
যদিও আমাদের বাড়ি ছিল
প্রত্যন্ত গ্রামে, কিন্তু আমার দুজন দাদা, দিদি ও বৌদি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মেজদার বিশ্বাস ছিল কমিউনিজমের ওপর। ফলে বাড়িতে বিভিন্ন সাহিত্যধর্মী বইয়ের পাশাপাশি ছিল
কমিউনিজমের অনেক বইয়ের সম্ভার। বিশেষকরে প্রচুর বাংলা অনুবাদের রাশিয়ান বই। কিছুটা
হলেও আমি ভাগ্যবান তেমন কিছু বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলুম। আর্টকলেজে পড়ার সময়
সপ্তাহান্তে যখন বাড়ি আসতুম, যাওয়া আসার পথে ট্রেনে পড়তুম ঐ সব বই। সে সময়ই পড়েছি
মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’, আন্তন মাকারেঙ্কোর তিনটি
খন্ডের ‘জীবন জয়ের পথে’র মতো বহু বই। ইস্পাত আমার জীবনের প্রথম প্রেম। কিশোর পাভেল
কোরচাগিন আর তোনিয়ার প্রেম আমার সে বয়সে প্রভাব এনেছিল। তবে তার আরও একটা কারণ
‘ইস্পাত’ বই-এর ইলাসস্ট্রেশন। নিজে ছবি আঁকতুম বলেই হয়তো ইলাসস্ট্রেশন এতো টেনেছিল! যাঁরা
পুরোনো ‘ইস্পাত’ বই পড়েছেন, তাঁরা জানেন কী অসাধারণ ইলাসস্ট্রেশন ছিল ওই বইয়ে। একটা
ছবি আজও স্পষ্ট মনে আছে, কিশোর বয়সী পাভেল ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে। মাথায় রাশিয়ার গরিব
মানুষদের টুপি। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর কোট। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তোনিয়া। তোনিয়ার
মাথায় ধনী সমাজের পাতলা ফিনফিনে শাদা টুপি, শাদা সার্ট আর ঘাগরা। কী যে অপূর্ব
ছবি! সেই ইলাসস্ট্রেশনই বোধহয় আমার প্রথম প্রেম! তোনিয়া আর পাভেল যখন ভাগ্যচক্রে
আলাদা হয়ে গেল, তখন খুব কেঁদেছিলুম।
আন্তন সেমিওনভিচ
মাকারেঙ্কোর ‘জীবন জয়ের পথে’ কত জন পড়েছেন আমি জানিনা, আমি ভাগ্যবান ওঁর তিনটি
খন্ডই পড়েছি। এবং এই বইয়ের মূল্য আমার জীবনে অসীম। মাকারেঙ্কো অপরাধজগতের কিশোর
কিশোরী, যুবক যুবতী, ছেলেমেয়েদের নিজের দায়িত্বে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে তাদের কেমন
করে বড় করলেন, মানুষ করলেন, সে সব নিয়েই লেখা। যা না পড়লে ভাবাই যেত না একজন
মানুষের সারা জীবনের আত্মত্যাগ কী হতে পারে! গ্রামের মধ্যে পরিত্যক্ত খামার বাড়িতে
নিজেরাই অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন অনন্য পাঠশালা। যদি বলা
যায় পরিশোধনাগার, তবে তাই-ই। পরিশোধনাগার এমনই তো হওয়া উচিত! জীবনের সুদীর্ঘ পথে
কত যে প্রতিকুলতা, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে অবিচল থেকে ওই জেলখাটা অপরাধীদের কাউকে
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, গবেষক, পাইলট হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, যা জানলে
অবিশ্বাস্য মনে হবে! অবিশ্বাস্য এই আত্মত্যাগ! এই আত্মত্যাগ হয়তো সম্ভব হতো না যদি
উনি কমিউনিজমে বিশ্বাসী না হতেন!
আর্ট কলেজের শেষের দিক। ভালো সিনেমার সঠিক ধারণা
তখনও জন্মায়নি। কলকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহের দৌলতে কিছু ভালো ছবির স্বাদ পেতে শুরু
করেছি। তখনও ছাত্রাবস্থায়। ফলে চাইলেই বেশি সিনেমা দেখা সম্ভব ছিল না! তবুও সে সময়
নন্দনে দেখালাম রাশিয়ান সিনেমা ‘দ্য ক্রেন্স আর ফ্লাইং’। সাদাকালো। একটি প্রেমের
কাহিনি, কিন্তু তা যে কোন স্তরে এসে শেষ হতে পারে, না দেখলে আমার কোনো ধারণাই
জন্মাত না।
প্রথম দৃশ্য
থেকেই ভেরোনিকা আর বরিসের দুরন্ত প্রেম। এক সেকেন্ডও যারা দুজন দুজন কে ছেড়ে থাকতে
পারে না। ব্রীজের ওপর থেকে দুজনে দ্যাখে মেঘের কোল দিয়ে কেমন করে এক ঝাঁক বলাকা
উড়ে যায়। ভেরোণিকা নিজেও যেন বলাকার মতো উড়ে বেড়ায় সারাক্ষন।
প্রথম
দৃশ্যে ভেরোনিকা আর বরিসকে প্রায় সারা রাত এখানে ওখানে ছোটা ছুটি করতে দেখা যায়।
একদন্ডও কেউ কাউকে যেন ছেড়ে থাকতে পারে না। প্রেমে পড়লে যেমন হয়। বাস্তবের মাটিতে
কেউ তখন আর যেন থাকেনা। সবাই উড়ে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তবতা? সে কি সহজে সবাইকে ছেড়ে
দ্যায়? ভেরোনিকা বরিসকেও ছেড়ে দিল না! কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের জীবনে নেমে এলো কঠিন
বাস্তবতার আঘাত। সব ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল! বেজে উঠল ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা! ভরঙ্কর
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মোকাবিলা করতে বরিসকে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে যেতে হলো
যুদ্ধক্ষেত্রে। হঠাৎ কী যেন সব ঘটে গেল! যুদ্ধে যাবার বেলায় ভেরোনিকা আর বরিসের
দ্যাখাও হলো না! ভেরোনিকার সকালেই বরিসের বাড়ি এসে দ্যাখা করার কথা ছিল। কিন্তু
যুদ্ধের জন্য পথে শত শত সাঁজোয়া গাড়ি আর রাস্তার দু-ধারের হাজার হাজার মানুষের ভীড়
ঠেলে ভেরোনিকা আসতেই পারছিল না। সাহস করে সাঁজোয়া গাড়ির গতিপথে ঢুকেও কোনোক্রমে
যখন সে পৌঁছল তখন বরিসকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। বরিস অপেক্ষা করেও যখন ভেরোনিকার দেখা
পেল না, সে তার ঠাকুমার কাছে ভেরোনিকার জন্য একটা প্যাকেট দিয়ে গেল, সঙ্গে একটা
ছোট্ট চিঠি। ভেরোনিকা আসাতে ঠাকুমা তার হাতে প্যাকেট-টা তুলে দিলেন। কাগজ জড়ানো
একটা কাঠবেড়ালির পুতুল। সঙ্গে একটা চিঠিও আছে জানাল। চিঠিটি কিন্তু খুঁজে পেলনা
ভেরোনিকা। ঠাকুমাও অবাক! চারদিক খুঁজে কোথাও পেলেন না। ভেরোনিকা ছুটল স্টেশনে যদি
বরিসের সঙ্গে শেষ দ্যাখা হয়! কিন্তু হাজার হাজার সৈন্য আর তাদের পরিবারের ভীড়ে
বরিসকে দূর থেকে দেখেও কাছে যেতে পারলো না। হাজার মানুষের কোলাহলে ভেরোনিকার ডাক
বরিসের কানে গিয়েও পৌঁছোলনা!
বলাকার
মতো দুরন্ত ছুটে বেড়ানো মেয়েটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়লো। কয়েকদিনের মধ্যেই
হিটলার বাহিনীর বোমারু বিমানে ভেরোণিকাদের বহুতল বাড়িটি নিশ্চিহ্ন! আন্ডার
গ্রাইন্ডে আশ্রয় নিয়ে সে বেঁচে গিয়েছিল। তবে তার বাবা মা নিজেরদের বাড়ি ছেড়ে যাবে
না শপথ করে সর্বনাশ ডেকে আনল। বোমারু বিমান চলে যাওয়ার পর ভেরোনিকা আন্ডার গ্রাউন্ড
থেকে বেরিয়ে দেখল তাদের বাড়িটির কোনো চিহ্ন নেই। মা বাবার কোনো অস্তিত্বই নেই। নিরাশ্রয়
মেয়েটিকে আশ্রয় দিল বরিসের পরিবার। বরিসের বাবা মা জানত তাদের প্রেমের কথা। শ্বশুর
বাড়ির মতোই তারা ভেরোনিকাকে কাছে টেনে নিল। কিন্তু বরিসের সম্পর্কের একভাই, মার্ক
ভেরোনিকাকে ভালোবাসত। ভেরোনিকা একদম পছন্দ করতো না তাকে, কিন্তু মার্ক কিছুতেই
তাকে ছাড়বে না। বরিস যুদ্ধে যাওয়ায় মার্কের আরও সুবিধা হয়ে গেল ভেরোনিকাকে কব্জা
করার। একদিন বিশেষ এক পরিস্থিতে সে ভেরোনিকাকে ধর্ষণ করল। ভেরোনিকার সম্পূর্ন অমতে
তাকে বিয়েও করল। বরিসের পরিবার কিছুতেই মানতে পারলনা এই হঠকারিতা। তারা ভেরোনিকাকেই
এর জন্য দায়ি করেছে! মার্ক আর ভেরোনিকার দাম্পত্য জীবন বিন্দুমাত্র সুখের হয়নি।
ভেরোণিকা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। তার মন থেকে বিন্দুমাত্র বরিস হারিয়ে যায়নি! তার
শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধুই বরিস।
যুদ্ধের
সময়। স্বভাবতই তাদের পরিবারকে আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে আন্ডাগ্রাউন্ডেই থাকতে হতো।
একদিন সেখানেই একজন ভদ্রমহিলা ভেরোনিকাকে বললেন, ‘আমি বরিসকে জানিনা, সবাই বলছে সে
ছিল ঈশ্বরের দান’। ‘ছিল’? শব্দটি ভেরোনিকাকে চমকে দিল! ভেরোনিকা স্বগতোক্তির ঢঙে
বলে উঠল, ‘ছিল?’
মহিলা - ‘মিসিং প্রমান
করে না সে মৃত।’
ভেরোনিকা – ‘আমি সব
হারিয়ে ফেলেছি।’
‘তোমার সামনে গোটা জীবন পড়ে রয়েছে।’
‘আমি আর বাঁচতে চাইনা।’
‘অতীত ভুলে যাও।’
‘এটাইতো মানুষের ধর্ম,
ভুলে যাওয়া। কিন্তু আমি ভুলে যেতে চাইনা। ভুলে যাওয়ার জন্য আমি কিছুই চাইনা!’
‘তুমি নিজেকে সারা জীবন
এভাবে শাস্তি দিয়ে যেতে পারো না!’
‘আমি জানি আপনি ইতিহাস
পড়ান, আপনি খুব বুদ্ধিমতী মহিলা, কিন্তু আমাকে বলতে পারেন, জীবনের অর্থ কী?’
‘জীবনের অর্থ?’
ভদ্রমহিলা কিছু উত্তর দিতে
যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে মার্ক এসে পড়ায় তাদের কথা হলনা।
বরিসের চিঠির
জন্য জানলার দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে বসে থাকে ভেরোনিকা। কিন্তু কোনোদিনও তার
নামে বরিসের চিঠি আসেনা। বরিসের ডাক্তার বাবা ইভানভিচের তত্ত্বাবধানে নার্স হিসেবে
হাসপাতালে সে কাজ শুরু করলো। প্রতিদিন শয়ে শয়ে আহত সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাসপাতালে
ভর্তি হতে আসছে। অনেক সৈন জায়গা না পেয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছে। একদিন এক
আহত সৈন্য খুবই অস্থির হয়ে মানসিক অবসাদে নিজের ব্যান্ডেজ খুলে চিৎতকার করে বলতে
থাকল, সে আর বাঁচতে চায়না। পাশের একজন সৈন জানাল ওর প্রেমিকা ওকে ছেড়ে অন্যজনের
কাছে চলে গিয়েছে, তাই ও এমন করছে। ভেরোনিকা বুঝে উঠতে পারলো না সে কী করবে? ছুটে
ডাক্তার ইভানবিচকে ডেকে নিয়ে এল। ইভানবিচ শুনে ছেলেটিকে কিছু উপদেশ দিলেন। মোদ্দা কথা একটি
মেয়ে ছেড়ে গিয়েছে বলে জীবন শেষ করে দিতে হবে এর কোনো মানে নেই। মেয়েরা হ্যান্ডসাম
ছেলে পেলে কেটে পড়তেই পারে। ওরা এমনই অকৃতজ্ঞ! ভেরোনিকা মনে করলো কথাগুলো যেন তাকে
উদ্দেশ্য করেই বলা। প্রচন্ড আত্মসম্মানে লাগল তার। নিঃশব্দে সেখান থেকে ছুটে
বেরিয়ে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে রেল লাইনের ওভারব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েও পারলনা।
কারণ তার হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি বাচ্চা ছেলে গাড়ির সামনে। মুহুর্তে সে বাচ্চাটিকে কোলে
তুলে বাঁচাল। বাচ্চাটির বাবা মায়ের খোঁজ নেই। তাকে আস্তানায় নিয়ে গেল। কিন্তু
বাচ্চাটির কান্না সে কিছুতেই থামাতে পারছিল না। ভেরোনিকা তার ট্রাঙ্কে রাখা বরিসের
দেওয়া কাঠবেড়ালিটা ছেলেটিকে দিয়ে কান্না থামাতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্রাঙ্ক ও
অন্যান্য জায়গায় তন্ন তন্ন খুঁজেও সে কাঠবেড়ালি পুতুলটি পেল না। জানতে পারল ওটা
মার্ক এক বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টিতে নিয়ে গিয়েছে। ঠিকানা জেনে ভেরোনিকা ছুটল
সেখানে।
ভেরোনিকাকে ওই
পার্টিতে হঠাৎ দেখে মার্ক অবাক হল। ভেরোনিকা লক্ষ্য করলো তার কাঠবেড়ালি টেবিলের
ওপর পড়ে। সবার হাত ঘুরে চলেছে একটি চিঠি। একজনের হাত থেকে চিঠিটি ছিনিয়ে ভেরোনিকা পড়া
শুরু করেই বুঝল এটা সেই বরিসের লেখা তাকে উদ্দেশ্য করে শেষ চিঠি। যা সেদিন খুঁজে
পাচ্ছিল না। “My only love, happy birthday to you. On this day you came in to this World. It’s hard to leave you. But
what can we do? This is war. There’s no way around it. We can’t continue living
happly as we did before when death stalks our land. But we’ll be happy yet. I
love you. I have faith in you.
yours Boris.”
মার্কের স্বভাব
মোটেই ভালো ছিল না। তার কাজ প্রতিদিন পার্টিতে যাওয়া আর গান বাজনা ফুর্তি করা।
অন্য মহিলার সঙ্গেও সম্পর্ক। অন্যান্য দু একজনের কাছ থেকে ইভানবিচের কানে এসেছে
কথাগুলো। ইভানবিচ একদিন মার্ককে ভেরোনিকার সামনেই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করলেন
এবং মার্ককে তাদের আস্তানা ছেড়ে চলে যেতে বললেন। কিন্তু ভেরোনিকাকে থেকে যেতে
বললেন তাদের সঙ্গে।
একদিন
যুদ্ধ ফেরৎ একজন সৈন্য তাদের আস্তানায় এল বরিসের সংবাদ নিয়ে। ভেরোনিকাকে সামনে
পেয়ে জানতে চাইল বরিসের পরিবারের কেই আছেন কিনা? ভেরোনিকা জানাল, সবাই বাইরে।
ছেলেটি বলল, আসলে আমি মিস্টার ইভানবিচের ছেলে বরিশের খবর নিয়ে এসেছিলাম। ছেলেটির
ধারানা হয়েছিল ভেরোনিকা বরিসদের বাড়ির সদস্য নন। বলল, তবে আপনাকে বলা যেতেই পারে,
আপনি তো ওদের বাড়ির কেউ নন। বরিস যুদ্ধে মারা গিয়েছে। ভেরোনিকা সে সময় জামা কাপড়ে
সাবান দিচ্ছিল। স্তব্ধ হলো তার হাত। পাথরের মতো হয়ে গেল সে! ছেলেটি বলল, বরিস একটি
মেয়েকে খুব ভালোবাসত। জানিনা সে কোথায় আছে! ভেরোনিকা বলল, আমিই সেই মেয়ে। ছেলেটি
হাঁ হয়ে গেল! কী বলবে বুঝে উঠতে পারলনা। ভেরোনিকার সাবান মাখা হাত জড়িয়ে ধরে
চুম্বন করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। জানাল কেমন করে বরিসের জন্য তার জীবন
রক্ষা পেয়েছে। বরিস নিজের জীবন দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে গিয়েছে। আহত তাকে নিজের কাঁধে
করে জল কাদার মধ্যদিয়ে পিঠে বয়ে এনেছিল। একটু বিশ্রামের জন্য যখন তাকে মাটিতে রেখে
দাঁড়িয়েছে তখনই বরিসের গুলি লাগে। ভেরোনিকা বলল, কিন্তু তার যে মৃত্যু হয়েছে তা
আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন? আপনি কি ওকে কবর দিতে দেখেছেন? ছেলেটি বলল, না, তা
দেখিনি। ভেরোণিকা বলল, আমি বিশ্বাস করি না বরিস মারা গিয়েছে। সে ঠিক বেঁচে আছে।
যুদ্ধ
শেষ। বিজয়ী সৈন্যরা বাড়ি ফিরছে। তাদের সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ
যেমন অপেক্ষা করছে তেমনি তাদের পরিবারের মানুষজনও ফুলের তোড়া নিয়ে অধির অপেক্ষায়। ভেরোনিকাও
ফুলের তোড়া নিয়ে খুঁজে চলেছে তার প্রিয় বরিসকে। একবার ভুল করে এক জনকে বরিস ভেবে
জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বুঝল অন্য কেউ। বিভিন্ন পরিবারের মানুষরা তাদের প্রিয়জনকে জড়িয়ে
ধরছে, আনন্দে কেউ কাঁদছে, কেউ নাচছে। ভেরোনিকার দু চোখ উদভ্রান্তের মতো খুঁজে চলেছে
বরিস কে! সহসা বরিসের কাছের বন্ধু ইভানের সঙ্গে দেখা। তারা দুজনে এক সাথেই যুদ্ধে
গিয়েছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভেরোনিকা ইভানকে জড়িয়ে ধরলো। কারো কাছ থেকে পাওয়া
ফুলের তোড়া ইভান ভেরোনিকার দিকে বাড়িয়ে দিল। ইভান বুঝতে পারল ভেরোনিকা কিছু জানতে
চাইছে কিন্তু পারছে না যেন বলতে! ফ্যাল ফ্যাল করে ইভানের দিকে তাকিয়ে। ইভান কিছু
বলতে পারল না শুধু বুক পকেট থেকে ভেরোনিকার ছবিটা বের করল। অবশিষ্ট ক্ষীন আশাটুকুও
আর রইল না। ভেরোনিকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। হাউ হাউ করে কেঁদে ফুলের তোড়াগুলোকে বুকে
জড়িয়ে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। সবাই আনন্দে আত্মহারা, কেউ লক্ষই করলো না ভেরোনিকা ফুলের
তোড়া বুকে জড়িয়ে কিভাবে কেঁদে চলেছে! শুধু একজন বয়স্ক প্রান্তন কমান্ডার ভেরোনিকার
কান্না দেখে বললেন, মা এই মুহূর্তে সবাই আনন্দে আত্মহারা হলেও কেউই ভুলতে পারে না যারা
যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিয়েছে।
বিজয়ী
সেনাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ইভানের বক্তৃতা ভেসে এল ভেরোণিকার
কানে। “Dear
mothers, fathers, sisters
and brothers. The happiness of our reunion is immeasable the heart of every
Soviet citizin in filled with joy. Joy sings in our hearts. It is victory that has brought us
this joy. We have all waited for this moment. Time will pass. Towns and
villages will be rebuillt our wounds will heal. But our fierce hatred of war
will never diminish: We share the grief of those who can not meet their loved
ones to day, and we will do everything to insure that sweethearts are never
again parted by war. That mothers need never again fear for their children;s
lives. That fathers need never again choke back hidden tears. We have won and
we shall live not to destroy but to build a new life.”
বৃদ্ধ
কমান্ডারের পাশে দাঁড়িয়েই ইভানের বক্তৃতা শুনছিল ভেরোনিকা। শেষ হলে কমান্ডার
বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে কেন মা, যাও তোমার তোড়া থেকে একটি করে ফুল ওদের দাও! ভেরোণিকার
চোখের জল তখন শুকিয়ে গিয়েছে। সে একটি একটি ফুলের স্টিক এক এক জনকে দিতে থাকল।
একজন সৈন্য চিৎকার
করে বলে উঠল, ওই দেখো মস্কোর আকাশে বলাকার ঝাঁক উড়ে চলেছে (The cranes are flying)। ভেরোনিকাও তাকাল আকাশের দিকে। মনে পড়ল, বরিসের সঙ্গে ব্রীজের ওপর থেকে
একদিন ঠিক এমনই একঝাঁক বলাকা উড়ে যেতে দেখেছিল তারা।
।। সমাপ্ত।।
এতো নিখুত টানটান চিত্রনাট্য,
অভিনয়, ফটোগ্রাফি, লোকেশন, সেট ডিজাইন প্রায় সমস্ত দিকি থেকে এক অসামান্য
উপস্থাপনা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫। মাত্র ১২ বছর পর ১৯৫৭ The cranes are flying নির্মিত হয়েছিল। ভেরোনিকার
চরিত্রে তাতিয়ানা সামইলোভা-র অভিনয়ের কোনো তুলনাই হয়না। যেন জীবন থেকে উঠে এসেছে
চরিত্রটি। কমিউনিজমের আদর্শে ভরপুর এ ছবি চিরকালীন ব্যক্তি প্রেমকে সর্বাঙ্গীন স্তরে
উন্নিত হওয়ার এক অনন্য উদাহরণ। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে। অথচ এতটুকু অবাস্তব মনে
হয়নি। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আদর্শ মনে হয়নি। আমি নিশ্চিত কমিউনিজমের আদর্শে
উদবুদ্ধ না হয়ে এ ভাবনা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। লেখার শুরুতেই জানিয়েছিলাম
পারিবারিক সূত্রে আমার একটু ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল কমিউনিজমের প্রতি। কিন্তু সে ভালোবাসা
ভাবনাকে আরও শত উপরে নিয়ে গিয়েছিল The cranes are flying চলচ্চিত্র টি। একটা চলচ্চিত্রই যেন কমিউনিজম
সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছিল আমাকে।
মাঝে
মাঝে ভেবে অবাক হই কী এমন ফাঁক ছিল এই কমিউনিজমের, যা কয়েক দশকের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে
গেল? এটা তো মানতেই হবে রাশিয়ার প্রতিটি মানুষের আত্মবলিদান ছাড়া ভয়ঙ্কর হিটলারের
থেকে পৃথিবী রক্ষা পেত না। সমগ্র রাশিয়াবাসী যেভাবে লড়াই করেছে ইতিহাসে তার স্থান
অনেক ওপরে থাকবে। তবুও এই ত্যাগের কোনো মূল্যই থাকল না। কমিউনিজম পতনের পর সে
দেশটার অবস্থা ভাবলে কষ্ট হয়!
কমিউনিজম
সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক আলোচনাও শুনি। শুনি স্তালিনের অনেক পৈশাচিকতার কথা। পোলান্ডের
পরিচালক আঁন্দ্র ভাইদার প্রায় প্রতিটি ছবিতে রয়েছে স্তালিন বিরোধী মতবাদ। কমিউনিজমের
এক অন্ধকার দিক। সব কিছুরই ভালো মন্দ দুটো দিক রয়েছে। কার পাল্লা ভারি তা অবশ্য
আমার পক্ষে বলা সম্বব নয়। কেউ ভাবতে পারেন চলচ্চিত্র আলোচনায় এসব কেন? আসলে The cranes are flying এমনই একটা ছবি যার প্রতি
বিন্দুতে মিশে রয়েছে কমিউনিজমের সততা। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তাই কথার পিঠে কথাগুলো চলে
এলো।
ভালো লাগল। সিনেমাটা দেখিনি। তবে দেখার ইচ্ছে রইল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো দাদা, পড়লাম।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো দাদা, পড়লাম।
ReplyDeleteBhalo lekha
ReplyDeleteবেশ ভাল বলেছেন...
ReplyDelete