মোবাইল ফোনটা তিন আঙুলের কায়দায় আলতো ধরে, আহ্লাদি গালে নরম আভাষে বুলোয়। লাউডস্পিকারে। কিছুক্ষণ লাউড শোনে। গালে বুলোয়, কথা বলে, কথা শোনে। গলায়, বুকে বোলায়। গলা গলগল করে, গলা শুকিয়ে আসে ও উদগ্রীব হয়; অপরপ্রান্ত যেন বুঝি হয়ত লেহন-রত… কপাল থেকে শুরু করেছে, এক্ষণে গ্রীবায়। সমীরের জিভে খুব আঠা, খুব জল, লালা। …আর বুকে, তাহলে বলি শোনো।
বুকে খুব মায়া হয়। সেথা চনমন থাকে। চিনচিন করে; সেথা আরও যা, তাহা নরম, মৃদু। স্পিকারের ভল্যুম শেষ সীমায়, বুকে রাখলে ঝম ঝম বাজে। যেন কথা কইছে ওইখানে ঠোঁট রেখে, সমীর। কেয়ার রিনিরিনি হয়, উঠে আসে পায়ের পাতা থেকে। রিনিরিনি তার দেহের নানা-স্থলে থামে ও কিছুক্ষণ নেচে নেয়। সে তা অ্যালাউ করেই শুধু নয়, মজা খায়।
লাউড থামায়, কানে ধরে; বলে...শোনে। আবার
কান থেকে নামিয়ে অন করে স্পিকার। শ্রবণ আর কথনের প্রচুর, কেয়াকে ভাসিয়ে রাখে। ৪৬৬ কিমি বিরহ, বুকে ভাইব্রেট করে।
এই হ্যান্ড-সেটটার স্পিকার খুব দমদার। ত্বকে আওয়াজ কাঁপে, গা শিরশির করে। হাসছে,
সমীর। কেয়া বলে, এই! তুমি খালি এত হাসো বলে কি তোমার পদবি ‘হাঁসদা’? সে-কথায় সমীর মনে হয় আরও হেসে উঠলো আর তা শুনে কেয়াও। ‘মনে হয়’ এই জন্যই বললাম, কেননা, সমীরের ব্যাপারটা আমি দেখতে পাচ্ছি না, আর সেটাই যুক্তিপূর্ণ। লিখছি বলে কি ল্যাজ গজিয়েছে নাকি যে একই সাথে দু জাগায় উপস্থিতি? কী? কেয়ার ফোনের লাউডস্পিকার অন ছিল, আমি শুনতে পেয়েছি সমীর কী শব্দ কীভাবে করছিল? …না। শুনিনি। আমি কি গা-ঘেষে দাঁড়িয়ে আছি নাকি, সুগন্ধী কেয়ার? মোটেও না। লেখক নিজের উপস্থিতি জানান দিলে চরিত্ররা তাদের
চলাফেরার সতর্কতা লুকোতে পারেনা।
বা, ধরি, সমীর হাঁসদা তখন গান গাইছিল আসলে…। তার সাথে চামড়ার কোনও বাদ্য। কেয়ার
উথাল বুকে।
“দেখ্যে বাড়ালি তকে
তুই না দিলি হামাকে
বুকের মাঝে শিমল কঁড়ি দলকে
সেই দেখ্যে মন ললকে…” আর তাই না শুনে কেয়া নিজের সাথে ঢলাঢলি। হুঁ… হুঁ… হুঁ…। বটে, বটে। সে তার শিমূল-ফুল বুকে ফোন-কথা ভাইব্রেট হতে দেয়; পরাগে, রেণুতে। …এই! খেয়েছ, না? তোমার গানের কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে যে… আমার হাঁস আমার নাদুস নুদুস হাঁস, চই চই চই চই...
এতদিন আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হয় বুঝি! এই হাঁসদা! প্যাঁক প্যাঁক! কোন পুকুরে,
তুই! আমার চিকিচিকি!
***
সমীর নিজের রক্ত আর জিন নিয়ে ভাবে। সে ঝাড়খণ্ডের কাঁকে মানসিক হাসপাতালে।
কেয়াও মনোরোগ, তবে স্বাধীন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে। তিন দিন নিজের চেম্বার, দুই দিন এক
নার্সিং হোমের ঠাণ্ডা ঘরে বসে প্রেসক্রিপশন লেখে। ফাঁকা সময়ে ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট
দেয়। ফুলের পাশে বসে সেলফি। সুস্থ থাকার নানা উপায় শেয়ার করে, মন বিষয়ক। সে নিজের
রক্ত বা জিন নিয়ে সেভাবে ভাবে না। সেও সমীরের এথ্নিক বিশিষ্টতা নিয়ে কাটাকুটি
খেলে। তবে সমীরের মতো নয়, ... না, সমীরের মতো নয়।
সমীর, ১৭৮৯ এ গিয়ে ভাবে, তিলকা মাঝির সাথে তার কোনও পূর্বপুরুষ অস্ত্র
উঁচিয়েছিলেন, ব্রিটিশের খেলাপ। সে-কথায় সে অনন্ত ধুলোর পরত পার করে পৌঁছতে পেরেছে।
সে ভাবে, পেরেছে; সময় ও ভূগোলের দিশা মেপে, পায়ে পায়ে। সমীর এরকম আরও কিছু কথা
পেরেছে। সে ভাবে, পেরেছে। মুখার্জি স্যারের মেয়ে, কেয়া। তাকে কিছু খুঁজতে হয়না, সে
জন্মমাত্র মুখার্জি পেয়েছে। মুখার্জি স্যার, অনেক্ষণ সমীরের দিকে চেয়ে-চেয়ে,
অভেদ্য, পারাপারহীন দূরত্ব থেকে বলেছিলেন, ‘নির্বোধ!’। ... তখন, আসলে, অ্যাবোর্ট
এর অ-সম্মতি দিয়েফেলেছে, কেয়া, তার বাবাকে।
আরও সামান্য কয়েকটা কথা জানতে চেয়েছে কেয়া, মুখার্জি স্যারকে। সেগুলো পরে
বলেছিল। ইনফ্যাক্ট, সবটাই বলেছিল ঝাড়খণ্ডের তালঝারিতে আত্মগোপন পর্বে। ...
১) তোমারও তো কৈশোর-যৌবন, বাপি, কেটেছে সাঁওতাল পরগণায়। তুমি নাকি নিজেকে
সাঁওতাল বলতে বেশি গর্ব বোধ কর।
উত্তরঃ এখন আর করি না। এক সময় করতাম। বাংলাদেশ থেকে বাপ-ঠাকুরদা ভিটে ছেড়ে উপুড় হয়ে
এখানে এসে পড়ল, দুমকায়। শেকড় বুঝিস খুকি? কী বুঝবি তুই!
...এখন এই তিন-তলা বাড়ি আমার। ভোটার, রেশন, আধার, প্যান, ড্রাইভিং লাইসেন্স! এই
পশ্চিমবঙ্গে! এসবের কে ইয়ে, বল? তুই-ই, একমাত্র! ছেলেটার কেমন ভাবলেশহীন মুখ! কী,
অ্যাঁ! ডাক্তার তো কী হয়েছে! পেয়েছে তো ইয়েতে!
২) সমীরের ভাব-ভাষা-কথা তোমাকে এভাবে বুঝতে হবে কেন বাপি! আর তুমিও জানো,
জয়েন্টে ওর নাম জেনারেল র্যাঙ্কেই ছিল ১২২!
উত্তরঃ আমি তোর বা-বা!! কী বলছিস মা? তোর শশুর শাশুড়ি দেওর হাঁড়িয়া খেয়ে নাচবে আর আমি
সেখানে বসে তোর বিয়ে দিব, অ্যাঁ?
বাবার মুখে শোনা অলীক-প্রায় শাল মহুয়া টাঁড় মালভূমির ছবি জলে ভিজে যায়। সেই-জলে
মুছে যায় তাতলোই উষ্ণ প্রস্রবণ, মালুটির ইতিহাস;
ভরে যায় মসাঞ্জোর ড্যাম। ছোট্ট
থেকে শোনা দুমকা কেঁদে কঁকিয়ে ওঠে। বাপি, তুমি তবে মিথ্যে বলেছিলে? তুমি তবে মিছে
মানুষ, ঝুঠা দিকু! সাঁওতাল ভাবতে নিজেকে কখনও, মাতৃহারা; আসলে তবে তো তুমি বিষ-তির
পাও! প্রাপ্য তোমার!
***
সিন সহজে শেষ হয় না। ...
তারপর আরও দেখা যায়, সমীরের ফোনের ডিজিটগুলো কেয়ার ডিজিটের উপর আর কেয়ার ফোনের
বোতাম সমীরের ‘ঐ’ এর নিচে।
᱐
|
᱑
|
᱒
|
᱓
|
᱔
|
᱕
|
᱖
|
᱗
|
᱘
|
᱙
|
০
|
১
|
২
|
৩
|
৪
|
৫
|
৬
|
৭
|
৮
|
৯
|
কেয়া এক সময় ঝাঁপিয়ে-দাপিয়ে ওঠে, বলে, বাঃ খুব ইয়ে, না? তখন এমন হয়ঃ
৯
|
৮
|
৭
|
৬
|
৫
|
৪
|
৩
|
২
|
১
|
০
|
᱐
|
᱑
|
᱒
|
᱓
|
᱔
|
᱕
|
᱖
|
᱗
|
᱘
|
᱙
|
সমীর বলে ‘ইয়ে’টা তুমি টিপিএম স্যারের কাছে পেয়েছ। স্যার তোমাকে আরও কিছু
দিয়েছেন; কী কী তাকি তুমি জানো?
টিপিএম না বলে শ্বশুরকে সোজা পুরো নামেও ডাকতে পার। তারাপদ মুখার্জি।
ইয়োরোপ-আমেরিকায় তো তা-ই ডাকে।
না না, কী কী তাকি তুমি জানো? কেয়া, জানো?
সে-সব জাগায় কিনশিপ্ এর বোলবালা নেই...
আরে বলো না, আরও কিছু দিয়েছেন তোমাকে তোমার বাপি, তাকি তুমি জানো?
জানি, গায়ের রং। মুখের আদল। হাইট। ...
গমের মতো, টলটলে, ছিপছিপে। ...
শুনতে ভালো লাগছে সমীর... বলো...
ভালো লাগছে কেন জানো? বন্দনা শুনছ যে! ওগুলো ‘বন্দনা-শব্দ’ কেন বলো তো? ওগুলো
আর্য-সুলভ, তাই! আমি এই একপেশে নন্দন-বিভ্রমে বসে বসে তোমাকে দেখি আর, মনে ভালোবাসা
জাগাই।
তোমার নান্দনিকতার তবে আরও তো কোনও ইচ্ছে আছে? অভিলাষ? আরাম ও তৃপ্তি? যা,
রক্ত থেকে আসে? বা, যা তোমার মন কে বশ্যতায় বাধয করেনি! আর, আর্যপূর্ব! আমার দিকে
চেয়ে তোমাকে ভালোবাসা ‘জাগাতে’ হয়, স্বতঃ আসেনা, তাই না!
দ্যাখো, বেশ কেমন শ্লেষ এসে গেলনা কি, তোমার বক্তব্যের অন্তিম টানে? মুখার্জি
স্যার এও কি তোমাকে দেননি? না জেনে-বুঝেই বহন করছ তুমি, তা।
এমন ভাবে আমরা কথা বলব সমীর? আমরা যে তাহলে খুব খারাপ দিকে চলে যাব বাবু ...
না, দেখ, কেবলই কি বাহ্যিক দিয়েছেন তোমাকে মুখার্জি স্যার? দেখ, কত ভেতরের ব্যাপারও তো আছে...
***
অসম্মত ছিল কেয়া, তবু প্রকৃতি নিজে থেকেই কেড়ে নিয়েছে; তার গর্ভাশয়ে থাকতে
দেয়নি দুই মাস এগারো দিনের বেশি। নাম রাখা হয়ে গিয়েছিল আগেই, পিকাসো। হাঁসদা, না
মুখার্জি? শুধু পিকাসো?
কাঁকে ড্যামের ধারে সেন্টেনারি পার্কের নির্জন বেঞ্চে বসে ভাবে সমীর। কেয়ার
প্রশ্নে তার জবাব ছিল, হাঁসমুখ। পিকাসো হাঁসমুখ! যার মুখে সদাই হাসি। এলোনা, শুধু
নামটা থেকে গেল, অক্ষয়। মা তো সে, যে আসতে পারেনি তার জন্য কেয়াও কি এমন নির্জনে
বিষণ্ণ বোধ করে? আচ্ছা, কেয়ার তো বিষণ্ণতার আরও ঢের কারণ থাকতে পারে। তাদের দুজনের
মন-খারাপের কমন পয়েন্টগুলো কি খুব বেশি নয়?
(কেয়াকে নিয়ে বসুন না ডাক্তার হাঁসদা!)
ওকে। কেয়াকে নিয়ে আসুন। ওর সাথে বসছি। ... আপনাদেরও জেনে রাখা দরকার যে, আমি
কী কী উপায়ে তার অ্যাসেসমেন্ট করব। সেগুলো শুনুনঃ Appearance, Attitude, Behaviour, Mood
and affect, Speech, Thought process, Thought
content, Perceptions, Cognition, Insight আর তারপর Judgment। হলো?
এসব করতে করতে আমি যখন এগোবো, আপনারা উৎসুক আনন্দে। আনন্দে
বললাম বলে খারাপভাবে নেবেন না। আনন্দ অনেক রকম হয়। মুশকিলটা কোথায় জানেন? বেশ,
জানুন। দুটো মুশকিল আছে। দুটোই এক নম্বরে।
১/ক) সম পেশাঃ কেয়া আর
আমি দুজনই ‘মন’ নিয়ে তো পেশা করি, তাই ওকে আমার পক্ষে ‘ধরা’ বেশ শক্ত। আমাকে
এক্ষেত্রে তার মনমতো দিকে সহজেই ঘুরিয়ে দেবার চালগুলো সে পারবে। এন্ড ভাইসেভার্সা, অফকোর্স!
১/খ) ক্রস-কালচারাল সমস্যাঃ এটা ‘১/ক’
এর থেকেও সাঙ্ঘাতিক বাধা। একটু ভেবে-টেবে সহজ করে বলি? সমস্যা নেই তো? বেশ। ...দেখুন
যে-যে ভাবে আর যেমন যেমন কারণে মুখার্জিরা হাসে কাঁদে গানগায় শোয় ঠিক সেই সেই ভঙ্গিমায়
আর কারণসমূহে হাঁসদারা ঐ ঐ গুলো নাও করতে পারে; আসলে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই, তা
করেনা। আপনারা আমার চেম্বারে কেয়াকে নিয়ে আসবেন যখন, তার অ্যাপিয়ারেন্স কোনও একজন
হাঁসদা মেয়ের সাথে আকাশ-পাতালও হয়ে যেতে পারে।
বা ধরুন, চাইবাসার ঘুটঘুটে এক গ্রামের মাঠে ফুটবল ম্যাচ কেন্দ্র করে মেলা
জমেছে। এসব আবার হাটবারে হয়। হাঁসদা খেলা দেখছে আর খেলার মেলায় চানাচুর দিয়ে দিয়ে
একটু একটু মহুয়া খেতেখেতে কেয়াকে দেখছে। দেখছে, হাসছে। হাসছে, কাছাকাছি যাচ্ছে।
যাচ্ছে, হাত ধরছে। তখন আবার সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে, একটু পরে দশ হাত দূরের মুখ ঝাপ্সা
হয়ে যাবে। হাত ধরছে হাঁসদা, মুখার্জির। চাঁদের আলোর টানে দুজনের ছায়া নিয়ে ঢুকে
যেতে চায় শাল মহুলের বন দিয়ে সরু হাঁটা পথে। সেটুকুই প্রতিশ্রুতি, সেই হাত-ধরা;
সেটুকুই সাক্ষী, সেই বনপথ, নির্জন পায়ে হাঁটা। ... মুখার্জি তো এগোনোর আগে
সই-সাবুদ চাইবে, সিঁদুর-টিঁদুর চাইবে। সে মারান্ডি, বাসকি, সরেন হলে নিজেও
দু-পাত্র মহুয়া খাবার ইচ্ছে জানাতো, এক খিলি পান খেয়ে, ঠোঁট উল্টে ঠোঁটের রং দেখে
হিহি হেসে ভেসে যেতে পারত ধরা হাত আরও মজবুত করে ধরে, শাল পিয়াল মহুয়া কেন্দ
দেবদারু ঘুঘু শালিখ টিয়া প্রজাপতি চাঁদের আলো আর মাতাল বাতাসকে সাক্ষী মেনে।
মুহূর্তটুকুকে লুফে নিত অনন্ত সময়ের সংক্ষেপে। মুখার্জি আর হাঁসদার সিটিঙের
সাফল্যের মাঝে বহুবিধ বন-পাহাড়-পশুপাখি আর বাঁচন-বৈবিধ্য এসে পড়ে যে...।
***
সঙ্কর হয়নি তার বহুবিধ,
সঙ্করায়িত চাতুরীতে ডোবে না সে। সমীরের জন্য মুখার্জি স্যার দ্বারা ব্যবহৃত ‘নির্বোধ!’
উচ্চারণটি কদাচ স্মরণে আসিলে সে আরশির সম্মুখে গিয়া দাঁড়ায়।
সেখানে নিজের চেহারা পুরো-পুরি দেখতে পায়না
সমীর। তাকে কেউ বা কারা যেন ঢেকে রাখে আজীবন। তার চাষ-আবাদ, তার উৎখাত, হেরিটেজ, তার
কোণ-ঠাসা, রক্ত, জিন, মন, জৈবিক অভিমুখ বহুদিন এইভাবে ঢাকতে ঢাকতে এইখানে এসেছে।
আসলে, বুঝতে পারে সমীর, বাস্তবে এটুকুও নেই। তার মনের জোর, তাকে এতটুকু, তবু,
দেখার সুযোগ করে দেয়। সঙ্করায়িত চাতুরীতে ডোবে
নি তার অন্তরাত্মা আজও। বদলে যায়নি জিনকোড, সবটুকু। যতটুকু দৃশ্যমান, মুখ-ভাবে,
সুদূর বিচ্ছিন্নতার বলীরেখা।
কেয়া খুব অল্প দিনে সীমা
শিখে ফ্যালে। জেনে নেয় ছিমছাম কত। তাই তার জন্য গর্ব, ধন্যবাদ, মায়াটান বেঁচেথাকে
সমীরে। কান্না আর শূন্যতা থাকে। ঘেন্নায় রম আর হুইস্কি ছুঁড়ে ফেলে ক্রমশ একদিন
হাঁড়িয়া আর মহুয়া তুলে নেয়। সন্ধ্যায় সেই চিরায়ত পেয়ালা হাতে বসে থাকে। সে
প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না। নন-প্র্যাক্টিসিং অ্যালাউন্সও নেয় না। সে সুপক্ব তুঁত
ফল দিয়ে নেশা পান করে। ...তিন মাস চার মাস বাদে সে কেয়ার কাছে যায়। কেয়া তার কাছে
আসে না। নিজের শহরে ওর খুব ব্যস্ততা থাকে; যে-ব্যস্ততা কেয়ার বহু সুচারু ভাবনার
ফল। এই জন্য গর্ব, ধন্যবাদ, মায়াটান বেঁচেথাকে সমীরে।
মুখার্জি তার নিচে শুতে
চায় না বেশিক্ষণ; উত্তেজনার গোঙ্গানিতে
কেয়া নিজেই উপরে উঠে বসে। সবদিন সেটা ভালো লাগে না হাঁসদার। মুখার্জি তার
পছন্দের ভঙ্গিতে পিষে ফ্যালে সমীরকে। মুখার্জি নিজেই করে, হাঁসদাকে সুযোগ দেয় না
করার। কেয়া সমীরের কর্তা হয়, কেয়া নিজেরও হয়, কর্তা। সমীরকে করে দেয়। নিজের করে
নেয়। হাঁসদাকে করতে দেয় না। সবদিন সেটা ভালো লাগে না হাঁসদার। মুখার্জি স্যারের
মুখ মনে পড়ে গেলে সেদিন আর দাঁড়াতে চায়না, নেতিয়ে যায় ইচ্ছা। কেয়ার আগ্রাসন তাকে
অনেকদিনই বিব্রত করে, থম্কে দেয়। কেয়ার হয়ে গেলে আর ভালোবাসে না সমীরকে। না হওয়া
ওব্দি বুকে মুখ ঘষে, হয়ে গেলে বুকে মাথা রেখে নিশ্চুপ অনুভবে যায় না।
সমীরের তো কখনও নিঃঝুম
বনবীথির নির্জন প্রশান্তি মেখে নিশ্চুপ অনুভব ইচ্ছে করে। তিতিরের নিঃশব্দ ডানার
শব্দ, কমনায় আসে। শর্তহীন অনার্য প্রীতি-সম্ভাবনার বাঞ্ছা জাগে কোথাও। চেয়ে থাকুক
শুধু তার দিকে, সামান্য কিছুক্ষণ ... মুগ্ধ হয়ে পাশে এসে বসুক কেবল। সেই প্রাপ্য
তার পাওয়া হল না এখনও। ... সমস্ত আবহে
শুধু দূর জেগে থাকে।
...ওটুকুই হয়, শরীরী
মুখার্জির দেহকামনায়। দুই কি তিন দিন কোনও মতে কাটে, যৌথ। সেই দুই-তিন দিনও ছুটি
নেই কেয়ার। নিশ্ছিদ্র নেই, ওই সামান্য সময়-পরিসরেও, সমীর-কেয়ার। ইচ্ছে করে শুধু
হাতে হাত রেখে বহুক্ষণ..., হাঁসদার। মুখার্জির ওসব আসে না। সে হাঁসদাকে হোম-ডেলিভারির নানাবিধ খাদ্যসম্ভারে ফেলে রেখে নার্সিং হোম, চেম্বার করে। সমীর সেইসব খাদ্যবস্তুর সামান্যতম ছোঁয়, একাএকা। একা খায়, একা হাসে, একা স্নান করে কেয়ার শহরের বুকে। … অত কথা বলে কীভাবে তবে কেয়া, রাঁচি ও নিজের দূরত্বে যখন। বহুক্ষণ, আয়েসে, ধীরে, তারিয়ে তারিয়ে! যেন কোনও ব্যস্ততা নেই জীবনে! শুধু সমীরের সাথে কথালীলা শুধু তার একরোখা চাওয়া! হেডফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতেও কান ভোঁ ভোঁ করে একসময়। মনে হয় কেয়াকে বুঝি জোর করে কেউ ব্যবচ্ছিন্ন করেছে সমীরের থেকে! … আর সেই মায়ামোহ টান, তবু, বারবার ফিরিয়ে আনে হাঁসদাকে, মুখার্জির শহরে। মুখার্জির শহরে এলেই কেন মুখার্জি আর কেয়া থাকেনা? ফোনের কেয়া? যেখানে তার মন বাজিয়ে তোলে সে? হাঁসদা কাছে এলে বাইরে এভাবে ঢুকে থাকে কেন কেয়া? নিজের ভেতরে ভেতরে ভেতরে আরও ভেতরে চলে যায় কেন। যেখানে যেতে পারে না সমীর। অনার্য সারল্য গোপন করেনা । অনার্য প্রাবল্য প্রকাশ করে না। উগ্র
হয়না, মুখার্জি স্যারের মেয়ের প্রতি। …খোঁজ
করে শুধু। ... চাষ-আবাদ পটু সমুদায়ের সদস্য, সে, আবার
কোণঠাসা হয়ে বনে-জংগলে ফিরে যেতে ভালবাসে!
…এভাবেই ব্যথা নিয়ে ফিরে যায়
হাঁসদা, বনাঞ্চলে। প্রতিবার। বনাঞ্চলে, দাবানল-প্রবণ, তার বিবাহ নিয়ে একা হতে ভালোবেসে। …তখন পল্লীতে গান হয়।
দা তালাং দাকা তালাং
ঝুমুর বাইহাদ রিন হাকু তালাং
আদহান ডোলাং রা-সে ক আ
আদহান ডোলাং তা-সে ক আ
না-সে না-সে ডোলাং জোজো আক
জিল কুটি কুটি সডম
সিবিল গে ঞ্জডম
সিডুপ আআতে জম গে রা-সে সোডম...
ঝুমুর বাইহাদ রিন হাকু তালাং
আদহান ডোলাং রা-সে ক আ
আদহান ডোলাং তা-সে ক আ
না-সে না-সে ডোলাং জোজো আক
জিল কুটি কুটি সডম
সিবিল গে ঞ্জডম
সিডুপ আআতে জম গে রা-সে সোডম...
[দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম ………]
অদ্ভুত একটা ভাবনা। সাংস্কৃতিক মিশ্রণটিও যে দোলাচল সৃষ্টি করেছে তা অনিবার্যভাবে খুব জীবন্ত আমাদের এক একটি উৎসবের প্রজ্ঞায় সম্মোহিত করে । বাংলা ভাষায় এরকম গল্প লেখা যায় তা আমাদের ভাবনারও অতীত।
ReplyDeleteগল্পের স্পন্দনটি ধরেফেলার জন্য ধন্যবাদ তৈমুরদা।
Deleteসত্যিই কি যে দোলাচল... ডাঙা আর জলের মিশ্রণটা না ঘোলাটে হচ্ছে না মূর্তি বানাবার মতো হচ্ছে... জীবন আটকে গেছে ফেঁসো জালে।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteএমন গল্প পড়লে অনেক কিছু শিখতে পারি বিশেষত আপনি যেভাবে একটি গল্পের নির্মাণ করেন...
ReplyDeleteধন্যবাদ বনমালী।
Delete